সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৭

শিক্ষায় দেওবন্দঃ মাথা ব্যথার কারণ কি ওহাবীবাদ নাকি কওমীবাদ । (আলোচ্যঃ ওহাবীবাদ,দেওবন্দ,আযাদী আন্দোলন,আসআরী,সালাফি,মাযহাব,সুন্নি)

কওমী মাদ্রাসার স্বীকৃতি অনেকের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে ।কেন এই মাথা ব্যাথা ? তাহলে ইতিহাস থেকেই শুরু করা যাক।
প্রথমেই জানতে হবে এই কওমী মাদ্রাসার মানুষগুলো কারাদেওবন্দ কী , ওহাবীবাদ কী, আযাদী আন্দোলন কী , এরা কি নতুন মাযহাব ?

প্রথমেই আযাদী আন্দোলনঃ
শাহ ওয়ালিওউল্লাহ দেওলভীর জন্ম ১৭০৩ সালে। যিনি আযাদী আন্দোলনকারীদের আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন । উপমহাদেশে হাদিসের সনদ বর্ণণার জন্য তার রেওয়াত ছাড়া অসম্পূর্ণ। তার পুত্র আব্দুল আজিজ দেওলভীই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ফতোয়া দেন। সৈয়দ আহমেদ বেরুলভী ছিলেন আযাদী আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের নেতা।
[বেরুলভীতে আরেকজন আহমেদ রেজা বেরুলভী ছিলেন। দুই জন আলাদা মানুষ।যা অন্য আলাদা ইতিহাস। নিজ উদ্যোগে পড়ে নিবেন।]
যার নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন বিভিন্ন হাত ধরে উপমহাদেশের আপামর মানুষের সমর্থন নিয়ে দীর্ঘ প্রায় ১০০ বছর চলে এসেছিল।


আযাদী আন্দোলনের একটি পোস্টার 

ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের লেখা ইন্ডিয়ান মুসলমানস বইতে এই নিয়ে তাদের যুক্তিমত তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে এই আন্দোলনকে শুরুর সময় ডাকাত, সন্ত্রাস ও পরে ওহাবী ট্যাগ লাগানো হয়। এই আন্দোলনে মানুষ নিজের শ্রম ,টাকা ও সমর্থনে যখন আকাশ ছুয়ে অবস্থা ঠিক তখনই ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন থেকে মানুষের সমর্থন কমানোর জন্য আযাদী আন্দোলনকে ওহাবী আন্দোলন বলে চালাতে থাকে। এই জন্য তারা মক্কার ঈমাম,মদিনার ইমাম, উপমহাদেশের অনেক আলেমকে দিয়ে ফতোয়া দেয়ানো হয়ঃ " আযাদী আন্দোলনটা মূলত ওহাবী আন্দোলন" বলে। প্ল্যানটা কাজ করে। সাধারণ মানুষ তখন কিছুটা আযাদী আন্দোলন থেকে দূরে সরে আসে। বালাকোট যুদ্ধের দিন হাজার হাজার যোদ্ধা/আলেম শহীদ হয়। পরে এই আন্দোলনটা আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ে। তখনো মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনের ধারা শুরুই হয় নি। আর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কাহিনীতো এই সেইদিনকার।
অনেক আলেম শহীদ হওয়ার পর ইসলামী শিক্ষাকে ঠিকিয়ে রাখতে ভারতের সম্মিলিত উলামাবর্গ দেওবন্দ নামক স্থানে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।যা দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা নামে সর্বাদিক প্রসিদ্ধ। আর বাকী আলেমরা ব্রিটিশের অত্যাচারের ভয়ে বিভিন্ন দেশে হিজরত করেন। দেওবন্দ স্থানটাকে ভারত সরকার বর্তমানে "দেওভৃন্দ" রাখতে সুপারিশ করা হয়।
দারুল উলুম দেওবন্দ 


এই আন্দোলনে মূল ভূমিকা রাখে ভারতের আলেমরা। যাদের সবাই হানাফি ফিকহ বা মাযহাবের অনুসারী। এই আন্দোলনের ফলে ভারতে হানাফি মাযহাবের ২টি অনুসারীর সৃষ্টি হয়-
১। হানাফি বেরুলভী।
২। হানাফি দেওলভী বা দেওবন্দী। যা ব্রিটিশ সরকারের ট্যাগ খেয়ে ওহাবী নামে চট্টগ্রামে খুব প্রসিদ্ধ।

এখন কথা হল ওহাবী আন্দোলন কী ? এরা কারা ?
ওহাবী আন্দোলনঃ ওহাবী আন্দোলনের মূল পুরোধা ও ধর্মীয় নেতা ছিলেন আব্দুল ওয়াহাব নজদী । যিনি তুর্কী সালতানাত এর বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে শির্ক-বিদআত নির্মূলের নামে হেজাজ ও মদিনার আশপাশ অঞ্চলে আব্দুল আজিজ আল সৌদ এর নেতৃত্বে  
যুদ্ধ করেন।এই আন্দোলনকে ওহাবী আন্দোলন বলা হয়।আব্দুল ওয়াহাব সহ এই আন্দোলনের যোদ্ধারা হাম্বলি মাযহাব অনুসরণ করতেন এবং সালাফি বিশ্বাস বুকে ধারণ করতেন।


বাংলাদেশে আহলে হাদিস ও ব্যাক্তি বিশেষ ছাড়া তেমন সালাফি নেই। তবে পুরো আরবে সালাফি বিশ্বাসী অনেক।
আর একজন হানাফি মাযহাবের অনুসারীরা আসআরী ও মাতুরিধি বিশ্বাসী । যা বিশ্বাসগত ভাবে বৈপারিত্য রয়েছে। তবে শিয়া থেকে হক দলগুলোকে আলাদা করার নিমিত্তে সুন্নী শব্দটার ব্যাপকতা পায়। ৪ মাযহাব ও ৩ বিশ্বাসকে সুন্নীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত বলতে মাযহাব হানাফি,শাফিই, মালেকি,হাম্বলি ও ৩ বিশ্বাস আসআরী ,মাতুরিধি ,সালাফিকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত হিসেবে বুঝানো হয়। যা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
ওহাবি আন্দোলনের বিজয়ের পর 

আর বাংলাদেশের কওমী সিলসিলার লোকগুলো আসআরী-মাতুরিধি,হানাফি, ৪ তরিকা মানে। এরা পীর-মুরিদও মানে। যা বেরুলভীরাও মেনে থাকে । তবে এদের ২ সিলসিলার মধ্যে অনেক মৌলিক পার্থক্য আছে যা ব্যাখ্যাগত, অতিরঞ্জিতকরণ, শির্ক,বিদআত সম্পর্কিত।

কেন কওমীদের নিয়ে এত রাজনীতি?
দেশে নামে বেনামে ১৪,০০০ কওমী মাদ্রাসা রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৪ লাখেরও বেশি। এরা রিলিজিয়াস ম্যাটার নিয়ে খুব একরোখা ও কট্টর। নেতৃত্ব মানার ব্যাপারে এরা খুব শক্ত , যা হেফাজত আন্দোলনে দেখা গেছে। বাংলাদেশের মূল জনসংখ্যার অর্ধ্যেকেরও বেশি কওমী সিলসিলা মেনে চলে। যাদের কট্টর মৌলবাদীও বলা যায়, যাদের ইতিহাসের পিছনে আযাদী আন্দোলন আছে। তাই দেশের জন্য এরা একটা ফ্যাক্টর। যা সরকার জানে।বিদেশী শক্তিরাও জানে।
 
তাই কওমীদের নিয়ে একেক জনের মাথা ব্যথার কারণ একেক রকম । কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের মান মাস্টার্সের সমমান পাওয়া নিয়ে দেশের বিবিধ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দলের মাথা ব্যথার কারণকে কেন্দ্র করে এসব দল-উপদলকে বিবিধ ভাগে ভাগ করে তাদের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করছিঃ

১। সরকার/আওয়ামীলীগঃ হেফাজতের আন্দোলন নিয়ে সরকারের সাথে কওমীদের সাথে একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছিল। ২০১৯ এর নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার তাদের নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমাতে চায়। তাছাড়া বিদেশি কিছু সংস্থার বুদ্ধিতেও এই অনুমোদন দেয়া হতে পারে।
২।বিএনপি ও সমমনা দলঃ শাপলা চত্তরের আন্দোলনের সময় বিএনপি ভেবেছিল কওমীরা হয়ত এবার বিএনপি হয়ে গেছে। ২০১৯ এর নির্বাচনে কওমীদের সমর্থন পাওয়ার বিএনপির আশায় আওয়ামীলীগ যখন পানি ঢেলে দিল তখন বিএনপি এই সনদের বিরোধীতা করে চলছে। কোটি কোটি ভোট বলে কথা !!!
৩। জামায়াতঃ ২০১৩ সালে যখন শত শত শিবিরের ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা যাচ্ছিল ঠিক তখনই হেফাজতের আন্দোলন শিবিরের আন্দোলনকে মাইনর করে দেয়। অনেক শিবিরের ছেলের প্রাণ বেচে যায়। এই আন্দোলন কাকতালীয়ভাবে শিবিরকে পঙ্গু হওয়া থেকে বাচিয়ে দিয়েছিল। জামাত এতে বেশি সুবিধা পায়। এবং কওমীদের নিয়ে তাদের আকিদাগত ও রাজনৈতিক পার্থক্য কমতে থাকে। বিএনপি সরকারের আমলে এই জামায়াতই কিন্তু কওমী মাদ্রাসা স্বীকৃতি অনুমোদনে বাধা দিয়েছিল। যার কারণে কওমীদের বিরাট একটা অংশ তখন থেকেই আওয়ামীলীগকে ভোট দিয়ে আসছে। কিন্ত মাদ্রাসা শিক্ষার মান দেয়াতে কওমীরা আওয়ামীলীগের কাছে চলে আসছে কিনা এই নিয়ে জামাতের মাথা ব্যাথা। এটা রাজনৈতিক। তবে ধর্মীয় দিক হতে বিরোধিতার কারণ- কওমি আলেমরা এখন সরকারী মাদ্রাসা, সরকারী চাকুরি সহ নানা কাজে অংশগ্রহনে তাদের আকিদাগত প্রসারতা লাভ পাবে।

৪।বেরুলভীঃ যারা নিজেদের তথাকতিত সুন্নি হিসেবে দাবী করে আসছে তারাই বেরুলভী।সরকারী মাদ্রাসায় হল এদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ধারা। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে কওমী ও বেরুলভীর মাঝে গালিগালাজীয় দ্বন্ধ চলে আসছে। তবে এখন বেরুলভী আলেমরা খুব শঙ্কিত। কারণ সরকারী মাদ্রাসা শিক্ষকতায় , ইসলামিক ফাউন্ডেশন, মসজিদের ঈমাম নিয়োগে,স্কুল কলেজে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগে ওয়াজের কারবারে, চাকুরীতে কওমীরা এখন অংশগ্রহনের সুযোগ পাবে । যা এতদিন বেরুলভীদের একছত্র ছিল।

৫। বাম /নাস্তিকঃ কট্টর মৌলবাদীদের এরা সবসময় ঘৃণা করে। তার উপর শিক্ষা ও কাজে মৌলবাদীরা নাক গলাবে তা কি সহ্য হবার মত !!! কোন নাস্তিকই তা মেনে নিতে পারে না।

৬। সালাফি ওহাবীঃ কওমী মাদ্রাসার এতদিনের নিজস্ব সিলেবাসের মৌলিকতাটা শিক্ষার মান পাওয়ার সাথে সাথে ভেস্তে যাবে কিনা তা নিয়ে সালাফিরা সন্দিহান। তবে অনেক সালাফি আকিদাগতভাবে কওমীদের হক মানে কিন্তু আদিপত্য ছাড়তে রাজি হয় না ।
সালাফির মূল শায়েখ ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ

৭। আহলে হাদিসঃ এদের এখনো গুটি কয়েক মাদ্রাসা ও স্কুল আছে । পিস স্কুল ও কলেজ সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। এরা নিজেদের সালাফি বলে এবং কওমী ও হানাফি ফিকহকে মানতে চায় না। তাই কওমীদের বিরোধীতা এদের বিরোধীতা।
আহলে হাদিস  শায়খ জাকির নায়েক


কওমীদের পক্ষে আবার দুটি মতঃ

৮। ফরিদ উদ্দীন মাসুদঃ কওমী অঙ্গনে অনেকেরই ঘৃণার পাত্র হলেও মাদ্রাসা শিক্ষার সবীকৃতি নিয়ে তার দৌড়ঝাপ ছিল বেশি। শুরুর দিকে মুফতি শফি সাহেবও স্বীকৃতির বিরোধী ছিলেন।
৯।মুফতি শফি ও বেফাকঃ
দেওবন্দ সিলসিলায় পরিবর্তনহীন সিলেবাস ধরে রাখতে বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষের দানের উপর চলে আসা কওমী মাদ্রাসা । মুফতি শফি সাহেব সব সময় কওমী মাদ্রাসার স্বকীয়তা ধরে রাখতে মাদ্রাসা শিক্ষার মান নিতে উদাসীন ছিলেন । কিন্তু কওমী অঙ্গনে বিভক্তির ইতি টানতে বেফাক প্রধান স্বীকৃতির ব্যাপারে কওমী মাদ্রাসার স্বকীয়তা ঠিক রেখে অনুমতি নেন।

১০। আমজনতাঃ
নতুন কওমী মাদ্রাসা এখন অনুমতি ছাড়াই প্রতিষ্ঠা হয়। কওমী আলেমরা নিজেদের ইচ্ছা ও সুবিধা অনুযায়ী কারো ডোনেশন নিয়ে মাদ্রাসা খুলে বসেন। যা অদূর ভবিষ্যতে অনুমতি নিতে অনেক কাটখড় পোড়াতে হতে পারে । আজ সিলেবাস অক্ষুন্ন থাকলেও ভবিষ্যতে সিলেবাস পরিবর্তন হতে পারে ।
অনুমতির ফাকফোকরে বিদেশি এনজিও মাদ্রাসায় ডোকার পথ পাবে।

মোদ্দকথাঃ রাজনীতিয় ও ধর্মীয় ফিত্নায় বিরোধীরা যায় বলুক না কেন অনুমতি পেয়েই গেছে। কিন্তু ভবিষ্যতের অবস্থা আল্লাহ ভাল জানেন। সময় তো আর বেশী নেই।

1 টি মন্তব্য: